Home » সংখ্যালঘুর ঘরে জন্ম নেয়াই কি আজন্ম পাপ?

সংখ্যালঘুর ঘরে জন্ম নেয়াই কি আজন্ম পাপ?

-বিধান রিবেরু’র স্ট্যাটাস থেকে

by ectbd@org
এমনিতেই দেশের নানা ধরনের ঘটনা দেখে ও শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটাই, তার ভেতর আজ (২২ মার্চ ২০২৪) ঘটে গেলো এক দুঃখজনক ঘটনা। আমার মনে হয় যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের মনেই এই ঘটনা নাড়া দেবে।
আমি ও আমার আট বছরের ছেলে গিয়েছিলাম একটি কাজে তেজকুনি পাড়ার একটি নির্মিয়মান ভবনে। নিচে গাড়ি রেখে গিয়েছি উপরে। আধ ঘন্টা পরই আমার ড্রাইভারের ফোন, উত্তেজিত গলা, স্যার তাড়াতাড়ি নিচে নামেন। আমি ছেলের হাত শক্ত করে ধরে নিচে নেমে এলাম। এসে দেখি লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। আমার ড্রাইভারকে উল্টোদিকের ভবনের এক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাহেবের ড্রাইভার গাড়ি সরাতে বলেছে গালি দিয়ে। উনারা স্থানীয়। আমাদের চেনে না। স্বাভাবিক গালি দিতেই পারে (!)। আমার ড্রাইভার তো তাকে চেনে না, (আমিও চিনি না), উল্টো গালি দেয়াতে সেই অবসরপ্রাপ্ত মেজর ছুটে এসে আমার ড্রাইভারকে লাথি মেরে বসে। আমি নিচে নামার আগেই এসব ঘটে গেছে। ততক্ষণে সেই মেজর উপরে চলে গেছেন, নিচে আছেন উনারই বড় ভাই। তো আমি নিচে নেমে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কি হয়েছে?
উনি খুব উত্তেজিত হয়ে আমার ড্রাইভারকে গালাগালি করতে শুরু করল। বললাম, আপনি শান্ত হন। এবং ঠিক তখনই, আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে ভদ্রলোক, আরো ক্ষিপ্ত হয়ে বলতে শুরু করল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি তার ভাই, তার আরেক ভাই প্রধানমন্ত্রীর কি কি যেন হন। তো আমি খুব বিনীতভাবে বললাম, এত ছোট ইস্যুতে আপনি প্রধানমন্ত্রীর রেফারেন্স দিচ্ছেন, তাকে টেনে আনছেন কেন? আর আপনিই বা কে? আমার এই প্রশ্ন শুনে উনি উল্টো যা বললেন, সেটা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
উনি বলতে শুরু করলেন, তুই আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করোস? তুই জানোস এই পুরা বিল্ডিং আমার? খ্রিস্টানিজম ফলাস? খ্রিস্টানিজম ফলাইতে আইছস? মুসলমানের দেশে খ্রিস্টানগিরি বাইর করে দেবো!! আমি হতবাক। আমি যে বিল্ডিংয়ে এসেছিলাম ও আমার গাড়িটি যে বিল্ডিংয়ের নিচে রাখা ছিল, সেটি বিল্ডিংটি খ্রিস্টান মানুষদের, মানে সব ফ্ল্যাট ওউনার খ্রিস্টান। তো আমি বললাম, আপনি এসব কি বলছেন? ভদ্রলোক (!) অযথাই চেচিয়ে বলতে লাগল, একটা ফ্ল্যাটও মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে নাই, দেখি এই এলাকায় খ্রিস্টান কেমনে থাকে? আমি ভাষা হারিয়ে ফেলছিলাম। ভাবছিলাম, পেছনেই হলিক্রস কলেজ। তার পাশে বটমলী স্কুল। তার পাশে গির্জা। উনি এতকিছু কিভাবে উচ্ছেদ করবেন?
যাইহোক, নিজের পরিচয় দিলেন উনি মুক্তিযোদ্ধা। তো আমি বললাম, চাচা প্লিজ আপনি শান্ত হন, আমার ড্রাইভারের গায়ে লাথি দেয়া ঠিক হয়নি, আর আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ভদ্রলোকের প্রত্যুত্তর– খ্রিস্টান আবার মুক্তিযোদ্ধা! তোর বাপ বা*লের মুক্তিযোদ্ধা। খ্রিস্টানরা সব আমেরিকারে সাপোর্ট করছে সেসময়, জানি না? তখন মনে হচ্ছিল, আমি ছুটে এসে বাবাকে বলি, কোন আক্কেলে তুমি যুদ্ধ করতে গেছিলা বাবা? তোমার জন্য আজকে দুইটা কথা বেশি শুনতে হলো। নইলে শুধু আমার উপর দিয়েই যেত। কিন্তু এখন গালাগালিটা গেল খ্রিস্টান মুক্তিযোদ্ধাদের উপরেও।
যাক, উনি আমাকেও গালাগালি করেছেন। আমি শান্ত থেকেছি। আশপাশের লোকজন বলেছে, ভাই আপনি ভদ্র মানুষ, থাক চলে যান। উনি এমনই। বললাম, উনাকে দেখতেও তো ভদ্রই লাগছে। পাশ থেকে এক লোক বলল, উনি সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে! আমিও বুঝলাম, আমিও সেই অন্য সবার মতোই, উনার খারাপ ব্যবহারের মুখোমুখি হয়েছি। আমি নিজের জন্য কিছু মনে করিনি। কারণ ছোটবেলা থেকেই ফিরিঙ্গির বাচ্চা ইত্যাদি শুনে বড় হয়েছি। আমি আঘাত পেয়েছি সবচে বেশি আমার বাচ্চা ছেলেটা আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং ও এই পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। বাসায় ফেরার সময় জিজ্ঞেস করেছে– লোকটা এমন করছিল কেন? ওকে তুমি পুলিশে দিতে পারলে না? আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। আর মনে মনে বললাম, কার কাছে কিসের নালিশ দিবো? আমার কাছে খারাপ লেগেছে, আমার ছেলেটাও, শুধু সংখ্যালঘু পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে, আজ এসব মানহানিকর কথা শুনেছে।
কোথায় গাড়ি রাখার মামলা, আর কোথায় ধর্ম তুলে গালাগালি! পরে ভাবলাম এটাই আমার পোড়াকপাল বাংলাদেশ। খুব হিসেবনিকেশ করেই আজ আমরা এই জায়গায় পৌঁছেছি। সবাই প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর কিছু না কিছু হয়। সবাই তাদের দেখিয়ে হুমকি-ধমক দেয়। সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার দেয়, বলে দেখে নেবে কি করে এলাকায় থাকব? কিন্তু আমি নিশ্চিত এই লোকটাকেই যদি আমেরিকার ভিসা করে দেয়া হয়, উনি তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দেবেন। এটাই আমাদের বর্তমান দেশের চিত্র। ক্ষমতালেহী, সাম্প্রদায়িক, ভণ্ড ও রংবাজ। মাঝে মাঝে মনে হয় এই দেশে জন্মানোটাই আমার বা আমার মতো সংবেদনশীল মানুষের আজন্ম পাপ।
বিধান রিবেরু
২২ মার্চ ২০২৪

You may also like

Leave a Comment