।। স্টাফ রিপোর্টার।।
ঢাকা, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার
বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সমাজের সুপরিচিত লেখক, গবেষক ও মানবাধিকার অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ড. ডেনিস দীলিপ দত্ত–এর নতুন গ্রন্থ ‘অরূপ তোমার বাণী’-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে শুক্রবার বিকেলে তাঁর নিজ গৃহে। অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ের ধর্মযাজক, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও চার্চ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাদার তপন ডি রোজারিও, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিবিসিএফ (বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপ)-এর সাধারণ সম্পাদক ও সিইও রেভা: লিওর সরকার, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির সেক্রেটারি রেভা: অসীম বাড়ৈ, বাইবেল সোসাইটির ট্রেজারার , পিটার তাপস মজুমদার, ইম্মানুয়েল ব্যাপ্টিস্ট চার্চের পালক পাস্টর তপন রায়, রেভা: ডেভিড এন. বৈরাগী, পাস্টর চার্লস, ন্যাশনাল খ্রিষ্টীয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের (NCFB) সেক্রেটারি মার্থা দাস প্রমুখ। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে পিটার তাপস মজুমদারকে। ভূমিকা লিখেছেন অধ্যাপক ফাদার তপন ডি রোজারিও। তিনি গ্রন্থটির ১০টি অধ্যায়কে কেন্দ্র করে সুন্দর করে নিজের মতামত ব্যক্ত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
যিশু খ্রিষ্টের জীবন ও বাণীকে কেন্দ্র করে ১০ অধ্যায়ের অনন্য গ্রন্থ- বক্তারা জানান, ‘অরূপ তোমার বাণী’ গ্রন্থের ১০টি অধ্যায়ে যিশু খ্রিষ্টের জীবন, ধর্মতাত্ত্বিক দর্শন, মানবমুখী প্রেম, ন্যায়বিচারের বার্তা এবং আধুনিক মানবতা–চিন্তায় তাঁর প্রভাবকে নতুনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি প্রচলিত ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ থেকে ভিন্নধর্মী একটি গবেষণানির্ভর কাজ। লেখক ড. দত্ত বলেন—“যিশুর জীবন আমাকে সবসময় নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। এই বই সেই অনুপ্রেরণা থেকেই লেখা। মানবতার প্রতি খ্রিষ্টের বার্তা আজও আমাদের সমাজকে পথ দেখাতে পারে।”
অনুষ্ঠানে ড. দীলিপ দত্তের জীবনসংগ্রাম, একাডেমিক পরিচয় ও চার্চসেবার প্রশংসা- বক্তারা তাঁর চার্চ নেতৃত্ব, সামাজিক সেবামূলক কর্মযজ্ঞ, মানবাধিকার চেতনা এবং দীর্ঘ সাহিত্য–গবেষণা জীবনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ড. ডেনিস দীলিপ দত্ত – সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি-জন্ম: ১৯৪২, ধামসর গ্রাম, উজিরপুর, বরিশাল; শিক্ষা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ. (অনার্স), এম.এ.; ১৯৬৯: পাকিস্তান সরকারের দমনপীড়নে দেশত্যাগ, পরিবারসহ ফিলিপাইনে অবস্থান; ফিলিপাইনে: ধর্মতত্ত্বে মাস্টার্স; মুক্তিযুদ্ধ: রাষ্ট্রদূত খুররাম খান পন্নীর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে প্রবাসে সক্রিয় ভূমিকা; দেশে ফেরা: ১৯৭২—চার্চ সেবা ও মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ; পুরস্কার ও সম্মাননা: ডক্টর অফ ডিভিনিটি (২০০৬), বাপ্টিস্ট ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স মানবাধিকার পুরস্কার (২০০৮), Pro Fide Award, ফিনল্যান্ড (২০১০) – দরিদ্র মানুষের জন্য অসামান্য সেবা; প্রকাশিত গ্রন্থ: ৩০টির বেশি-পেশা: গবেষক, লেখক, আন্তর্জাতিক রিসোর্স পার্সন, পরিবার: প্রথম স্ত্রী রোজী দত্ত (মৃত), দুই পুত্র উইলিস দত্ত (দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ১৯৮৫), বিলি দত্ত (অস্ট্রেলিয়া), কন্যা অর্ণিতা লিলি।
খ্রিষ্টান সমাজের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষায় ‘জাতীয় আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান
অনুষ্ঠানে চার্চ নেতৃবৃন্দ, গবেষক এবং শিক্ষাবিদরা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে একমত হন—
বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সমাজের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে এবং তা সংরক্ষণে জরুরি একটি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। বক্তারা বলেন—জীবিত এবং প্রয়াত বিশিষ্ট খ্রিষ্টান ব্যক্তিদের স্মারক, লেখা, চিঠিপত্র, ছবি, নথি, বাইবেল, ব্যক্তিগত ডায়েরি ইত্যাদি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। একটি কেন্দ্রীয় খ্রিষ্টান আর্কাইভ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। চার্চ, স্কুল, মিশন, সমাজকর্ম, সঙ্গীত, সাহিত্য—সব মিলিয়ে খ্রিষ্টান সমাজের বিস্তৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ অপরিহার্য।
অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেন—“বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সমাজের ২০০ বছরের ঐতিহ্য দলিলভিত্তিকভাবে সংরক্ষিত নয়। আমরা এখনই যদি আর্কাইভ শুরু না করি, পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস হারাবে।” পাস্টর তপন রায় ও রেভা: লিওর সরকার বলেন—“এটি শুধু চার্চের প্রকল্প নয়—এটি আমাদের সমাজের অস্তিত্ব রক্ষা।”
অনুষ্ঠানে বক্তারা ‘অরূপ তোমার বাণী’ গ্রন্থকে সমসাময়িক খ্রিষ্টীয় সাহিত্যচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি, ড. দীলিপ দত্তের জীবনসংগ্রাম, চার্চনেতৃত্ব, মানবিক–সামাজিক সেবা এবং গবেষণামূলক কাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল প্রতিধ্বনি ছিল—“আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে—এবারই সময়। একটি জাতীয় খ্রিষ্টীয় আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার কাজ শিগগির শুরু হওয়া উচিত।”
