বর্তমান বাংলাদেশে প্রাপ্ত গির্জার প্রারম্ভিক স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে হলে বিদেশী নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি তার উপর স্থানীয় প্রভাব বিশ্লেষণ করা জরুরী। বিশেষ করে বাংলা এবং ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার পটভূমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানীয় রীতি-নীতি, নির্মাণ পদ্ধতি এবং নির্মাণ সামগ্রী, জলবায়ু এবং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পদ্ধতি ও অবস্থাও জরুরী। এ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি বিশেষ প্রয়োজন। ঔপনিবেশিক বাংলায় নির্মিত কয়েকটি গির্জার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এদের গঠনশৈলী এবং বাংলার পরিবেশকে তুলনা করা বিশেষ প্রয়োজন।
আমরা জানি, মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত বাংলাদেশ তথা বাংলায় আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত জলবায়ুর প্রধানতম উপাদান। এ জলবায়ু ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষভাবে দেশজ স্থাপত্যকে প্রভাবিত করে। তুলনামূলকভাবে উচ্চমাত্রার আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের কারণে এখানকার কক্ষ পরিকল্পনায় আড়াআড়ি বাতাস চলাচল ও বৃষ্টি প্রতিরোধক ব্যবস্থা রাখতে হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মসজিদের মত গির্জাগুলোতেও এ পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। ফলে এ দেশে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ হতে এবং শীতকালে উত্তর হতে বায়ু প্রভাহিত হয়। ফলে এ দেশে আয়াতাকার ভূমি নকশায় নির্মিত নকশা বা কক্ষ বৃহত্তর দিক পূর্ব-পশ্চি দিকে রাখা হয়। পাশাপাশি বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্ব খোলা রাখা হয়। অন্যদিকে, বাংলার দেশজ স্থাপত্য রীতি ও স্থানীয় নির্মাণ উপাদান ঔপনিবেশিক যুগে নির্মিত গির্জাগুলোকে প্রভাবিত করেছে। তবে উল্লেখ্য করতে হয় যে, প্রধান নির্মাণ উপাদান হিসেবে ইটের নির্মাণ দেয়াল একমাত্র উপকরণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে স্থানীয় গির্জা নির্মাণে ট্র্যাবিয়েট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সহজভাবে বোঝাতে গেলে ছাদ নির্মাণে আনুভূমিক কড়ি, বর্গা ও টলম্ব পিলারের গঠন যুক্ত হয়েছে। খিলান, টারেট, কার্নিশ ও প্লাস্টারযুক্ত সমতল দেয়ালের গায়ে জ্যামিতিক নকশার অলংকরণ দেখা যায়। বাংলাদেশে নির্মিত গির্জাগুলোর সামনে অলংকরণকেও বহুলাংশে প্রভাবিত করেছে স্থানীয় শৈলী। বাংলাদেশের নানান এলাকায় এলাকায় ক্যাথলিক যাজকরা সর্বপ্রথম গির্জা নির্মাণ শুরু করেছিলেন। তবে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকায় তা ইউরোপীয় গির্জাগুলোর চাকচিক্য লাভ করেনি। ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত প্রথম গির্জা হিসেবে সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনোর গির্জার কথা বলা যায়। এ গির্জার স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা গেলে বাংলাদেশে প্রাথমিক দিকে বিশেষত ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত গির্জা স্থাপত্যের স্বরূপ সন্ধান করা সম্ভব হবে।
সারা বিশ্বেই অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর, ঐতিহ্যগত তাৎপর্য, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে গুরুত্বের সূত্র ধরে পুরোনো গির্জাগুলো হয়ে উঠেছে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। আমাদের গির্জাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থাপত্যের বৈচিত্র্য, ইতিহাসের স্বাতন্ত্রের আলোকে বাংলাদেশের পুরানো গির্জাগুলো অন্যতম নিদর্শন।
আর্মেনিয়ান চার্চ:
আরমানিটোলার এই গির্জাটি ঢাকার একমাত্র আর্মেনীয় স্থাপনা। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার বই “ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী”তে বলেছেন, “গির্জা তৈরীর আগে এখানে একটা ছোট উপাসনালয় ছিল। আর এর চারপাশে ছিল আর্মেনীয়দের সমাধিস্থল। পরে ১৭৮১ সালে বড় করে গির্জা তৈরির সময় ছয়টি কবর ও উপাসনাঘরের ভেতর পড়ে যায়।
মুগ্ধতা গাঢ় হয় সাদা-সোনালীতে মোড়ানো গির্জার আঙ্গিনা দেখে। শান্ত, নীরব, পবিত্র এক অনুভব ছড়িয়ে যায় মনে ও মননে। সমাধির সাড়িতে দেখা মিলে পোগজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক অধ্যক্ষ এনপি পোগজ-এর। এখানে ঘুমিয়ে আছেন মেন্ট গ্রেগরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এভিয়েটর গ্রেগরিও। প্রায় সব সমাধিতেই এপিটাফের ভাষা আর্মেনীয় ও ইংরেজী। দেখতে দেখতে কিছু এপিটাফের লেখায় চোখ আটকে যায়। ১৯২৯ সালের ২৪ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন ম্যাক এস ম্যাকারটিক।
আর্মেনীয়রা ব্যবসার উদ্দেশ্যে আঠারো শতকের দিকে ঢাকায় আসতে শুরু করেছিল। লবণ-চামড়া-কাপড়-পাটের ব্যবসা করে আর জমিদারি কিনে অল্প সময়েই তারা ঢাকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে উঠে। যে অ লে আর্মেনীয়রা ব্যবসা বা বসবাস করতে শুরু করে তার নাম হয়ে যায় আর্মানিটোলা। সেখানেই নিজেদের প্রার্থনার জন্য তারা নির্মাণ করেছিল এই গির্জা। তারপর কোম্পানি আমলের শেষ দিক এসে ব্যবসা করতে শুরু করে আর পাকিস্তান আমলের ঢাকায় আর্মেনীয়দের বাস প্রায় উঠে যায়। তবে আজও কালের সাক্ষী হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এপিটাফে ঘেরা এই শুভ্র গির্জা।
সেন্ট থমাস চার্চ:
সেন্ট থমাস চার্চ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর চূড়ায় বসানো ঘড়ি। গির্জা গায়ে প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট। আর চূড়ায় বসানো বিশালাকার ঘড়ি যেন ঘোষণা করছে সময়ের জয়যাত্রা। ভারত-উপমহাদেশের অন্যান্য অ লে উনিশ শতকে যে স্থাপত্যের অনুকরণে অ্যাংলিকান গির্জাসমূহ নির্মিত হয়েছিল, তার সঙ্গে এই গির্জার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দুইশ বছর হয়ে গেলেও গির্জার আসবাবগুলো এখনো অটুট এবং মজবুত। শুধু সচল নেই ঘড়িটি।
বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তরে শাঁখারীবাজার-এর পূর্ব পাকো-জনসন রোডে অবস্থিত এই গির্জা ঢাকার আদি গির্জাগুলোর একটি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বেশ কয়েকজন ইংরেজ কর্মচারী-কর্মকর্তা এ অ লে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের প্রার্থনার জন্য গির্জাটি নির্মাণ করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টান ধর্মের এক প্রবর্তক হলেন সেন্ট থমাস আর তাঁর নামানুসারেই গির্জাটির নামকরণ করা হয় “সেন্ট থমাস চার্চ”। ১৮৬৩ সালে গির্জাটির চূড়ায় ঘড়ি স্থাপন করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিগবেন এটি নির্মাণ করেছিল বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে, একসময় পুরান ঢাকাবাসী এ বিশাল ঘড়িতেই সময় দেখত। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বইটিতে বলা হয়েছ, “১৮১৯ সালে ঢাকা জেলের কয়েদিদের শ্রমে নির্মিত হয়েছিল এই গির্জা।
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ:
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ স্থানীয় মানুষের কাছে “লাল গির্জা” নামে পরিচিত। বরিশালের জীবনানন্দ দাশ সড়কে গির্জাটি। মূল গির্জাটির রং সত্যিই ইট-লাল। তবে এর অঙ্গিনায় রয়েছে সবুজের সমারোহ।
গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এক অপরূপ শৈল্পিক নিদর্শন বাংলাদেশেরা পুরানো গির্জাগুলোর তালিকায় অন্যতম এই অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। ৪০টি খিলানের উপর গির্জাটি দাড়িয়ে আছে আর সদৃশ্য পামগাছে ঘেলা এর চারিদিকের সীমানা। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বৃক্ষশোভিত উদ্যান। মাঠ, ফুল ও ঔষধি বাগান। বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনাকক্ষ এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ। গির্জাসূত্রে জানা যায়, প্রার্থনাকক্ষের চারটি বেদীর মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। আর বড় ক্রুশটি আনা হয়েছিল ফিলিস্তিনের বেথলেহেম থেকে। এর ছাদ কাঠের তৈরি, আর মেঝেতে সুদুশ্য মার্বেলের টাইলস। গির্জাটির স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল দেশীয় মাটি দিয়ে, পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে। গির্জার দক্ষিণ পাশে রয়েছে শানবাঁধানো বড় পুকুর। পুকুরের টলটলে জলে দেখা যায় এই নান্দনিক গির্জার প্রতিচ্ছবি। ৩৫ একর জমির উপর উঁচু প্রাচীর ঘেরা এই গির্জার অভ্যন্তরে ১৩টি ছোট-বড় পুকুর আছে। মূল গির্জার আদলে পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে বেল টাউয়ার। এখানে রাখা সুদৃশ্য ঘণ্টা দিনে সাতবার বেজে ওঠে, প্রার্থনার জন্য আহ্বান জানায় ভক্তদের।
অক্সফোর্ড মিশন গির্জার প্রাতিষ্ঠানিক নাম “এপিফানি গির্জা”। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ১৯০৩ সালের ২৬ জানুয়ারি এটির উদ্বোধন করা হয়। ঐ দিন-ই ‘এপিফানি গির্জা ভগ্নী সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১১৪ বছরের প্রাচীন এই স্থাপনা বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যের স্মারক। প্রার্থনা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি শিক্ষা বিস্তারেও অবদান রেখে চলছে। সিস্টার এডিথের নকশায় নির্মিত এ গির্জাটি একতলা হলেও এর উচ্চতা চারতলা ভবনের সমান (প্রায় ৫০ ফুট)। বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ ফাদার স্ট্রং সিস্টার এডিথের করা নকশা উন্নত ও চূড়ান্ত করেছিলেন। প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক ফ্রেডরিক ডগলাস। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ফলে আজও সগর্বে দাড়িয়ে আছে এই প্রত্নতত্ত্ব।
সেন্ট নিকোলাস চার্চ:
বাংলাদেশের পুরানো গির্জাগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ও বহু বছরের স্মৃতির স্মারক সেন্ট নিকোলাস চার্চ। দেয়ালে খোদিত সময়কাল বাংলাদেশের পুরানো গির্জাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই গির্জাটি। এটি আনুমানিক ১৬৬৩ সালে নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে, নতুন নির্মাণ তারিখ হিসেবে ঐ দেয়ালে লেখা ১৮৮৮ সাল।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে পর্তুগিজ খ্রিস্টান আসেন গাজীপুরে এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিক্রমে ১৬৬৪ সালে তারা গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী এলাকায় প্রথম গির্জা স্থাপন করে। পরে ১৬৮০ সালে পাকা ভবন হয়। পরবর্তীতে বেশ বড় আকারে আরেকটি গির্জা ভবন তৈরি করা হয়। ভবনের সামনে স্থাপন করা হয় হস্ত প্রসারিত যীশু খ্রিস্টের সৌম্যদর্শন এক মূর্তি। পর্তুগিজ স্থাপত্য নিদর্শনে তৈরি এই চার্চ দেখতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসেন। নতুন করে নির্মাণের পর বর্তমান সুদৃশ্য গির্জাটি দেখে অনেকে অবাক হতে পারেন। কেননা এতে আধুনিক নির্মাণশৈলীর ছাপ সুস্পষ্ট।
আমাদের ইতিহাসের বড় কিছু ঘটনা ঘটেছে এই গির্জাকে কেন্দ্র করে। এখান থেকে কালীগঞ্জের আ লিক বাংলা ভাষার প্রথম বাইবেল অনূদিত হয়। এমনকি বাংলা ভাষার প্রথম দ্বিভাষিক অভিধান ও প্রথম ছাপা বইও এখানে প্রকাশিত হয়। গির্জাটির স্থাপত্য পরিকল্পনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। লোহার ১২টি খুঁটির উপর দাড়িয়ে আছে একতলা গির্জা ভবনটি। এখানে রয়েছে বারান্দাযুক্ত প্রবেশপথ, সমবেত উপাসনার জন্য কক্ষ, বেদী ও একান্ত প্রার্থনাকক্ষ। তবে সেন্ট নিকোলাস চার্চে চিরাচরিত ‘নার্দেক্স’ স্থাপত্যশৈলীর পরিবর্তে বাংলাঘরের নির্মাণ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করা হয়েছে। এখানে দেখা যায় চারটি মজবুত খুঁটির উপর নির্মিত সমতল ছাদযুক্ত একটি বারান্দা। তাই একে ইউরোপীয় গির্জা স্থাপত্যের দেশি চরিত্র হিসেবেও ধরা যেতে পারে। এরা নির্মাতারাও ছিলেন দেশীয়। বর্তমানেও এটি যাজকদের রক্ষণাবেক্ষণে বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে, ধারণ করেছে সময়ের সাক্ষ্য। বারান্দা ১০২′-১০″ দৈর্ঘ্যের একটি হলরুমের সরাসরি ৩টি দরজাসহ প্রধান অংশ ৩৬′-৪″ প্রস্থ। ১০২′-১০″ ব্যবধানে ও-সেকশনে (৯″-৫″) লোহার দন্ডের বারোটি স্তম্ভ, রেলওয়ে বারের অনুরূপ, মোট স্থানকে ১৭′-৬″এর একটি প্রধান কেন্দ্রীয় স্থানে ভাগ করে প্রস্থ এবং পাশের স্থান প্রতিটি ৪′-৪″ প্রস্থ।
হলি রোজারি চার্চ:
বাংলাদেশের পুরানো গির্জাগুলোর মধ্যে এর তাৎপর্যতা বেশ গভীর। হলি রোজারি চার্চ পর্তুগিজ মিশনারিদের দ্বারা নির্মিত একটি গির্জা। ঢাকার তেজগাঁও-এ তেজকুনীপাড়ায়, বর্তমান হলি ক্রম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের পূর্বদিকে এটি অবস্থিত। সাদা-নীল দেয়ালের এই গির্জা ঢাকার অন্যতম প্রতœতাত্ত্বিক স্মারক।
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকায় পর্তুগিজদের বসতি গড়ে ওঠে। পর্তুগিজরা এখানে নিজস্ব বাণিজ্যকুঠি ও উপাসনালয় নির্মাণ করেন। আর সেই ধারাবাহিকতাই নির্মিত হয় এই গির্জা। কিন্তু গির্জাটির প্রতিষ্ঠাকালে ঐতিহাসিক, ভ্রমণকারী ও ধর্মযাজকদের মধ্যে ভিন্ন মতভেদ রয়েছে।
ইতিহাসবিদ জেমস টেলর বলেন, ঢাকার সন্নিকটে তেজগাঁও এর গির্জাটি ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে স্থাপিত। তাঁর মতে, প্রথমে এটি নেস্টোরীয় খ্রিস্টান বণিকদের দ্বারা নির্মিত হয় এবং পরবর্তীতে রোমান ক্যাথলিক মিশনারীগণ এটি সংস্কার করেন। ১৮৪৫ সালে ক্যালকাটা নিভিউতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে গির্জাটির নির্মাণকাল ১৫৯৯ সাল বলে উল্লেখ্য করা হয়। অন্যদিকে আরেকজন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জি.জি.এ কম্পোজ গির্জাটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেন।
মূলত ১৬৭৭ সালে নির্মিত এবং ১৭১৪, ১৯৪০ এবং সম্প্রতি ২০০০ সালে সংস্কার করা হয়েছিল। দেয়ালের বেধ এবং ছাদের পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য দুটি অংশ ইঙ্গিত দেয় যে, সম্ভবত অগাস্টিনরা পূর্ব অংশ নির্মাণ করেছিল পরবর্তী সময়কাল। বৃহত্তর পূর্ব অংশ দ্বারা ছোট পশ্চিমা অংশ সংযুক্ত করা হয়। ১১′-৪″ স্প্যানের ‘আর্চ অফ ট্রায়ামফ’ এর কুপভ আর্চওয়ে। পশ্চিম অংশ যা প্রাথমিকভাবে সম্ভব নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদের দ্বারা একটি চ্যাপেল হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। ১৭ শতকের শুরুর দিকে ৪৮″পুরু সুরকি প্রাচীর রয়েছে, শুধুমাত্র কয়েকটি ছোট উত্তরদিক খোলা। এই মূল চ্যাপলটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল : ক) বেদি, পশ্চিমে স্বাভাবিক স্তর থেকে ২′ উঁচু। খ) ম-লীর স্থান, উপাসক পূর্বদিকের বৃহৎ দেহটির দৈর্ঘ্য ৮৩′-৬″ এবং ৩২′-৩″। ১′৬″ এর দুটি সারিতে বারোটি বৃত্তাকার টাস্কান পিলার দ্বারা দুটি পাশের আইল। বাতাস চলাচলের জন্য দরজাগুলি উত্তর এবং দক্ষিণ দেয়ালে স্থাপন করা হয়।
বারান্দা :
বারান্দা হল ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় উপাদান যা বাংলার স্থাপত্য বহুদিন ধরে প্রচলিত সময়, যা জলবায়ু প্রভাবের পণ্য। গির্জার খোলার সুরক্ষিত বৃষ্টির জল এবং সরাসরি সূর্যালোক অনুপ্রবেশ রোধ করতে বারান্দাগুলোকে উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে বা পূর্ব বা পশ্চিমে একটি নর্থ বা মূল প্রবেশ।
উপাদান:
বেধ ১০′-৪০″ থেকে পরিবর্তিত, ইটের তৈরি, এবং ছাদ সরাসরি ভার বহন করে।
খিলান :
গির্জার খোলার সাথে খিলান খোলা অনুসরণ করা হয় বহু ফয়েল খিলানগুলোর সাথে, যা বাংলার একটি স্বতন্ত্র ধরনের, যা গীর্জাগুলোতে ব্যবহৃত হয়। পরিবর্তনগুলো, তুলনামূলকভাবে একটি বৃহত্তর স্প্যানে বেদী।
খোলা/ওপেনিং:
আর্কুয়েটেড এবং বর্গাকার হেডেড ওপেনিং উভয়ই পাওয়া যায়। খোলা অংশগুলি বেশিরভাগ উত্তর এবং দক্ষিণদিকে দীর্ঘ বা লম্বাভাবে স্থাপন করা হয়। প্রারম্ভিক পর্তুগিজ গীর্জাগুলোতে এই ওপেনিংগুলো উচ্চ পরিষ্কার আলোর অনুপস্থিতিতে দরজার পাশাপাশি পার্শ্বীর আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে অন্য ধরনের আলোকসজ্জা দেয়া হয়। খিলান এবং বর্গাকার দরজা খোলার মধ্যবর্তী স্থানটি রঙিন কাঁচের কাজ দিয়ে ভরা যা যদিও গথিত দাগযুক্ত কাঁচের মতো পরিমার্জিত নয় কিন্তু প্রভাব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। দাগযুক্ত কাঁচের কাজ পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক স্থানীয় ভবনকে প্রভাবিত করে।
সজ্জা:
প্রারম্ভিক গির্জাগুলি মুঘলদের দেওয়াল প্লাস্টারিং পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। পরে ইট চালু করা হয়। গথিক শৈলী অনুসরণ করে ব্যবহৃত স্টেইনড গ্লাস। জানালায় ব্যবহৃত রঙিন কাঁচ। ক্যাথলিক চার্চের সাজসজ্জা সহজ উদাহরণ হল: হলি ক্রস চার্চ, লক্ষীবাজার চার্চ, সেন্ট নিকোলাস চার্চ, হাসনাবাদ এবং পাথরঘাটা চার্চ। কিছু প্রটেস্টান গির্জা বাইবেল থেকে যীশু খ্রিস্টের কাহিনী চরিত্র জটিল বিস্তৃত দাগযুক্ত কাঁচের কাজ পাওয়া যায়, যেটির ইংরেজি গথিক চার্চের সাথে মিল রয়েছে। বিদ্যমান স্থানীয় গির্জার বাহিরের সম্মুখভাগের কোনো সাধারণ চরিত্র নেই। প্রবেশদ্বারের সম্মুখভাগের উপরে পেডিমেন্ট, যদিও এটি অভ্যন্তরকে প্রতিফলিত করে না বলে নির্বিচারে স্থাপন করা হয়েছিল। বিশেষ করে যেখানে বেল টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে সেখানে সাধারণ হয়ে উঠতে যেখানে ইংরেজদের দ্বারা নির্মিত প্রটেস্ট্যান্ট গির্জাগুলি উন্মুক্ত ইটের কাজ, বাট্রেস এবং অন্যান্য উপাদানগুলির সাথে চরিত্রে দৃঢ় ছিল। একটি পেডিমেন্ট সম্মুখের ক্রস এবং বেল টাওয়ার প্রতীক হয়ে ওঠে, যা কাঠামোর উদ্দেশ্য প্রমাণ করে।
উপসংহার:
খ্রিস্টান হওয়ায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা গির্জার প্রারম্ভিক নির্মাতা ছিলেন। বিদ্যমান প্রাথমিক গির্জাগুলো বেশিরভাগ পর্তুগিজ ক্যাথলিক মিশনারীজদের দ্বারা নির্মাণ হয়েছিল। ১৫ শতকে শুরু করে ১৮ শতকের মাঝে পর্যন্ত। পরেরটি ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাথলিক এবং প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতায় ব্রিটিশদের আহরণের পর নির্মিত হয়েছিল। বাংলায় ধর্মপ্রচারকরা তাদের দেশের চার্চের স্টাইল তারা সরাসরি অনুসরণ করতে পারেনি কারণ তাদের ভিন্ন সংস্কৃতি এবং জলবায়ু, ভিন্ন ভাষা এবং ধর্মের সাথে অতিক্রম করতে হয়েছিল। বিদেশী ব্যবসায়ীদের এই প্রাথমিক গির্জাগুলো বেশিরভাগ ছিল খুব সাধারণ নির্মাণ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় উপকরণ সহ সাধারণ কাঠামো। তাদের নিজস্ব জমিতে বিদ্যমান মহৎ কাঠামোর পরিবর্তে অস্থায়ী নকশা কাঠামো নির্মাণে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। বাংলায় নির্মিত গির্জায় দুটি কারণে কখনোই ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করতে পারেনি : (ক) প্রাথমিকভাবে পর্তুগিজ বসতি স্থাপনকারী এবং ধর্মপ্রচারকগণ যারা চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ধর্ম প্রচার করতেন, তাদের অনুকূল পরিবেশ ছিল ন। (খ) ১৬০২ সালে চট্টগ্রাম এবং পরে নোয়াখালীতে আরাকানি রাজার দ্বারা সম্পূর্ণ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছিল।